রহিম আব্দুর রহিম

সম্প্রতি গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। সুদূর পঞ্চগড় থেকে ঢাকা হয়ে জামালপুর। কখনও বাসে, কখনও ট্রেনে। সর্বত্রই আলোচনা-পর্যালোচনা ওবায়েদুল কাদেরের ‘কাউয়া-মুরগী’। কেউ কেউ তাঁর বক্তব্যকে যথাযথ বলেছেন। কেউ আবার মন্ত্রীর মুখে এ ধরনের বক্তব্য হাস্যকর, গুরুত্বহীন, আলতু-ফালতু বলে তিরস্কারের বাণী শুনিয়েছেন। যে যাই বলুক না কেন? ওবায়েদুল কাদের যে, রূঢ় সত্য কথা বলেছেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। ৭ মে রোববার জাতীয় দৈনিক সমকাল পত্রিকার প্রথম পাতায় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম ছিলো, আওয়ামীলীগে ‘অনুপ্রবেশ’ তৃণমূলের পরিক্ষিত নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ- শিরোনামের সংবাদ বডির সারসংক্ষেপ, বিভিন্ন দল থেকে অর্থাৎ বিএনপি- জামায়াতের নেতাকর্মীরা আওয়ামীলীগে যোগ দিয়েছে, যার সংখ্যা সারা দেশে প্রায় লাখের কাছাকাছি। যোগদানকারীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত এবং মামলার আসামী। আওয়ামীলীগের নবাগত এ আসামীরা কৌশলে দলে প্রবেশ করে দলের নেতৃস্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের মন্ত্র পড়িয়ে নিজস্ব অবস্থান সুদৃঢ় করছে। এমনকি এমপি মন্ত্রীরাও নিজস্ব বলয় তৈরীর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। এতে দলের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিবাদ তৈরী হচ্ছে পাশাপাশি পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। দলবাজরা রাতারাতি ‘মুজিবসেনা’ হয়ে উঠেছে। আওয়ামীলীগের নবাগত এই নেতাকর্মীরা কেউ মামলা মোকদ্দমা থেকে অব্যাহতি, কেউ আবার সুবিধা নেওয়ার জন্যই, আবার কেউ ঘরে ঢুকে সিঁধ কাটার জন্যই দলে অনুপ্রবেশ করেছে। এই নবাগতদের নিয়ে আওয়ামীলীগের দায়িত্বশীলরা যে সাফাই গিয়েছেন, তা শুধু দু:খজনকই নয়, দলের জন্য ভয়ঙ্করও বটে।

‘ভয়ঙ্কর’ শব্দটি কেন বললাম? তা পুরো লেখাটি পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন। জন্ম প্রত্যন্ত পল্লীর ভূঁতুড়ে গ্রামে। যে গ্রামে অত্যন্ত আধুনিক যুগেও রাস্তাঘাট সেই ব্রিটিশ আমলের মতই ধুলো-কাদায় পরিপূর্ণ। দু:খ নেই, আমরা মনে করি পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের কাব্যের উপকরণই আমাদের এই গ্রাম। এরপরও যুগের সাথে তাল মিলাতে আমরাও আধুনিকতার সাথে পরিচয় হতে চাই। আমাদের এমপিও সাহেবরা কয়েক বছরের মধ্যে রাস্তাঘাট পাকা করে দেবেন বলে কথা দিয়েছেন। মাঝে মাঝে আমি নিজেও আমাদের দৈন্যদশার কথা বলে আশার বাণী শুনেছি। নিরাশ হইনি। এবারের গ্রামে গিয়ে আশরাফুলের সাথে কথা হয়েছে। পাঠকরা মনে করছেন, এই আশরফুল হয়তো বা সাবেক আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। ভুলেও তা নয়। আশরাফুলের বয়স ২৫ কি ৩০ বছর হবে। ও বিএনপির অন্ধভক্ত। পেশা গাড়ীর হেলপার। গ্রামে বিএনপি খুঁজে পাওয়া মুসকিল, সবাই আওয়ামীলীগে যোগ দিয়েছে। আশরাফুলই যোগ দেয়নি। আমাকে পেয়ে ওর আর আনন্দ ধরে না। ছোট থেকে আশরাফুল আমাকে ভাই ডাকে। আমি ওকে পেয়ে খুঁশি হলাম, সারাদিন গাড়িতে থাকে, আরাম আয়েশ কই? নিয়ে গেলাম গ্রামের একটি চায়ের দোকানে, বেলা ডুবু ডুবু, প্রায় অর্ধশতাধিক জনমানুষের গ্রামীন আড্ডা, চলছে চা চক্র, গাল-গপ্প। আমাকে পেয়ে আনন্দের মাত্রা বেড়ে গেল। গল্পের আসর জমজমাট। আশরাফুলকে দেখেই সবাই বলাবলি শুরু করলো গ্রামে কোন বিএনপি নেই। একমাত্র আশরাফুলেই বিএনপি করছে। আমি এবার সুযোগ পেলাম, এতগুলো আওয়ামীলীগের মাঝে একমাত্র বিএনপি ‘আশরাফুল’। ওকে আমি চা খাওয়াবো, দোকানিকে অর্ডার দিলাম, এবার আশরাফুল বক্তৃতা শুরু করলো,‘আমাকে চা খাওয়াবে না তো কাকে খাওয়াবেন? আওয়ামীলীগে ভাইরাস ঢুকেছে। আমি ভাইরাস না। আরও কিছু কথা আছে এখন কমু না।’ আশরাফুলকে অনেক জোরাজুরি করলাম। আরও কিছু কথা বলার জন্য। সে বলতে রাজি না। আর যদিই বলে তবে ওকে ৪শ টাকা দিতে হবে। টাকাও দেওয়া হলো, না কথাও শোনা গেল না। তবে সর্বোপরি আশরাফুল বললো,‘আওয়ামীলীগের ভাইরাসরা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে আওয়ামীলীগের বারটা বাজাবে। অপেক্ষা করুন, সময় হলেই আমারে ডেকে মিষ্টি খাওয়াবে।’ রাতে কথা হলো, এলাকার পরীক্ষিত একদম অল্প বয়সের কিশোর-তরুণ নেতাকর্মীদের সাথে। তারা যেভাবে বলেছে, তাতে আওয়ালীগীগের তৃণমূলের অবস্থা মোটেই ভাল না। আগামী নির্বাচন ঘিরে দলের বিএনপি-জামায়াতের অনুপ্রবেশ তীব্র আকার ধারণ করেছে। এরা আওয়ামীলীগের ঘাড়ে ভর করে বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ের মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে। ওদের যৌক্তিক বক্তব্য হল,‘গত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনকে পুঁজি করে বিএনপি- জামায়াতের সাধারণ নেতাকর্মীরা আওয়ামীলীগে আশ্রয় নেয়া শুরু করে। স্থানীয় আওয়ামীলীগ মনোনীত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা এসমস্ত নবাগত কর্মীদের প্রথমে আশ্রয় দেয় এবং পরে তাদের পদ পদবী দিয়ে পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের কোনঠাসা করে রেখেছে। এসমস্ত নেতারা নির্বাচনের সময় বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে আওয়ামীলীগের প্রভাব ফেলে, বিএনপি জামায়াতের হয়ে কাজ করবে। ফলে আওয়ামীলীগ পরবর্তীতে সরকার গঠনে ব্যাপক বেকায়দায় পড়বে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এর অন্যতম কারণ নবাগত গ্র“পটি ডালে বসে ডাল কাটবে, অন্যদিকে পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা নিরব থাকায় আওয়ামীলীগের হিসাব নিকাশ পাল্টে যাবে।’ এদের কথা শোনার পর প্রশ্ন রেখেছিলাম, নিরব থাকায় লাভ কি? এ ধরণের প্রশ্নের উত্তরে ওরা বলেছে,‘যেভাবে দলে নবাগতদের আগমণ ঘটছে এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, পরীক্ষিতরা কোনঠাসা হচ্ছে, তাতে বিশ্বাস এই পরিস্থিতিতে যদি আওয়ামীলীগ পরবর্তীতে সরকার গঠন করে তবে, বাড়ি-বাড়ি, ঘরে-ঘরে ৭৫’র ১৫ আগস্টের মহাঝড়ের সম্ভাবনা রয়েছে।’ তাদের ধারণা সত্য না হলেও একেবারেই যে অবাস্তব, তা বলা যাচ্ছে না। আওয়ামীলীগের বর্তমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে অতিদ্রুত রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক গবেষণা অনিবার্য । মনে রাখতে হবে, ঘরের শিল্পীরা সুখে দুখে গান করে, অতিথি শিল্পীরা শুধুমাত্র পরিবেশ পরিস্থিতির মোকাবেলায় এবং মহা আনন্দ নেওয়ার স্বার্থেই সুর তুলে।

লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট